নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সমঝোতা কোন পথে

নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সমঝোতা কোন পথে

 

কীভাবে সংস্কার করা যায়, কীভাবে করা হলে তা টেকসই হবে—এগুলো নিয়ে অনেকের মধ্যেই অস্পষ্টতা ও ভিন্নমত রয়েছে। সংবিধান পরিবর্তন, নির্বাচন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে সমঝোতা কোন পথে হবে, তা নিয়ে লিখেছেন হাসনাত কাইয়ু

গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। অভ্যুত্থানের আগে স্লোগান ছিল—‘রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে’। অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার যে লাগবে, এ বিষয়ে ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলই একমত।

প্রায় প্রতিটি সক্রিয় দল, দলনিরপেক্ষ বিভিন্ন সংস্থা ও বিশিষ্ট নাগরিকেরা সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, মতামত দিচ্ছেন। সংবিধানের কোন কোন অংশ বদলাতে হবে, কী বাদ দিতে হবে, কী যোগ করতে হবে—এসব নিয়ে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। কিন্তু সংবিধানের সংস্কার যে করতে হবে, তা নিয়ো কোনো মতপার্থক্য নেই বললেই চলে। ৫ আগস্টের আগে সংবিধান সংস্কারের দাবি ছিল একটি অগ্রসর আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা। কিন্তু বর্তমানে সেই দাবি আর প্রত্যাশার স্তরে নেই; এটি এখন বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করেছে।

বাস্তবায়ন নিয়ে ‘ভিন্নমত’

বাস্তবায়নের এ পর্বে এসে এই সংস্কারের সীমা, পদ্ধতি ও এখতিয়ার নিয়ে আন্দোলনকারীদের নিজেদের মধ্যে মোটাদাগে কিছু মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। সীমা সম্পর্কে যেসব মতামত পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোকে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: এক. সীমিত সংশোধন (একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য এ সময়ে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু সংশোধন); দুই. বিদ্যমান সংবিধানটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং তিন. সংশোধন নয়, আবার সম্পূর্ণ নতুনও নয়, কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কার।

স্বাভাবিকভাবে বাস্তবায়নের এখতিয়ার ও পদ্ধতি নিয়েও মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো দল দাবি করছে, সংবিধান সংস্কারের এখতিয়ার এই সরকারের নেই। এটা করতে পারেন কেবল জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিরা। এ দাবি যারা করছে, তাদের একাংশ নির্বাচিত প্রতিনিধি বলতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কথাই বোঝাচ্ছে। তারা দাবি করছে, জাতীয় সংসদই সংবিধান পরিবর্তনের বৈধ কর্তৃত্ব। জাতীয় সংসদ ছাড়া এ পরিবর্তন করার বৈধ কর্তৃত্ব অন্য কারও নেই।

তারা অবশ্য এটাও বলছে সংসদ ছাড়া এ পরিবর্তন করতে পারে ‘বিপ্লবী সরকার’। কিন্তু ৮ আগস্ট তারিখে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তারা নিজেদের ‘বিপ্লবী সরকার’ হিসেবে দাবি করেনি; বরং বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করায় নতুন সংবিধান করার অধিকারও তারা হারিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে এ দাবির অর্ধেক সত্য ও অর্ধেক ভুল। সংবিধান সংস্কার কিংবা পরিবর্তনের ক্ষমতা অবশ্যই জনগণের, এটা সত্য। জনগণের পক্ষে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, এটাও সত্য। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের এ ক্ষমতা দেওয়া হয় না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় সরকার গঠনের জন্য। ‘সরকার’ সংবিধানের বিধান মেনে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দেশ চালাতে পারে, তারা সংবিধান বদলাতে পারে না। তারা সংবিধান রক্ষার শপথ নেয়, সংবিধান ভাঙার ক্ষমতা তাদের থাকে না।

তবে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও সংসদ সদস্যদের দুই–তৃতীয়াংশ একমত হলে পদ্ধতি মেনে ‘সংবিধান সংশোধন’ করার সুযোগ রয়েছে। এই ‘সংশোধন’ মানে ‘পরিবর্তন’ নয়। সে জন্য কোনো ‘সংশোধন’ যথার্থই সংশোধন, নাকি সংশোধনের নামে ‘পরিবর্তন’, তা পরখ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে উচ্চ আদালতকে। তাঁরা পরখ করে কোনো সংশোধনীকে বেআইনি বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। সম্প্রতি উচ্চ আদালত পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার রায় দিতে পারলেন, সেটা এ বিধানের ফল।

এ ছাড়া সংসদের মাধ্যমে গৃহীত কোনো সংশোধনীকে পরবর্তী সংসদ আবারও অন্য কোনো সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে দিতে পারে। সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা মূলত সংশোধনের কথা বলছেন। সংস্কারকে টেকসই করার কথা তাঁরা ঠিকমতো বিবেচনা করছেন বলে মনে হয় না।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *